শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কী? সাঁওতালদের ধর্মবিশ্বাস ও বিবাহপ্রথা লেখ।

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বলতে কী বুঝায়? সাঁওতালদের ধর্মবিশ্বাস ও বিবাহপ্রথা লিখ

ভূমিকা: সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নৃগোষ্ঠীগত বৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায়। এসব এথনিক গোষ্ঠী তথা নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে ঐক্য ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ সুগম হচ্ছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আরও সুদৃঢ় হচ্ছে। বিশ্বায়নের ইতিবাচক প্রভাব, সাংস্কৃতিক অভিযোজন, অঙ্গীভূতকরণ, উদ্ভাবন, সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ, আদান-প্রদান নীতি ও বহু সংস্কৃতিযাদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারণা বেগবান হয়েছে।

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কী? সাঁওতালদের ধর্মবিশ্বাস ও বিবাহপ্রথা লেখ।

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান: ধর্ম, বর্ণ, মতাদর্শপূর্ণ বিরোধ থাকা সত্ত্বেও মানুষ ইতিবাচক নিখক্রিয়ার পথ সুগম করে একটি শান্তিপূর্ণ ঐক্য, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ গড়ে তোলে এবং গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। মানুষের এই প্রচেষ্টা নিরন্তর, যা বহুমুখী বিভাজির সাংস্কৃতিকে আপেক্ষিকতার মাধ্যমে একসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করে থাকে। সংস্কৃতিগত দ্বন্দ্বের অনুপস্থিতি মানুষকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বাধ্য করেছে।

প্রতিটি এখনিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। তারা নিজেরা যখন তাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে তখন তারা তাদের নিজস্ব ভাষার কথা বলে থাকে, কিন্তু যখন তারা অপরাপর জনগোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তখন তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকে। তারা বাংলা ভাষাকে সাদরে গ্রহণ করে ভাষাগত সমন্বয় সাধন করেছে। এথনিক জনগোষ্ঠীরা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বাংলাদেশের সমাজে প্রচলিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্বকীয় অংশগ্রহণ করে থাকে। ফলশ্রুতিতে এথনিক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতিও গতিশীল হয়েছে। এখনিক জনগোষ্ঠীর সাথে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বসবাস একে অন্যকে জানার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ফলশ্রুতিতে তাদের ভেতরে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে এবং সহাবস্থানকে আরও বেশি শান্তিপূর্ণ করেছে। প্রতিটি এথনিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ধর্ম রয়েছে এবং তারা তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে ও নিরাপদে পালন করে থাকে। সাম্প্রতিককালে এথনিক জনগোষ্ঠী তাদের ঐতিহাগত ধর্ম ত্যাগ করে অধিকাংশই খ্রিষ্টান ও হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেছে। ফলশ্রুতিতে ধর্মীয় সম্প্রীতি সহাবস্থানকে সুদৃড় করেছে। প্রতিটি এথনিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা থাকলেও অনেক এথনিক জনগোষ্ঠীর ভাষা লেখার বর্ণমালা নেই। আবার অনেক এথনিক জনগোষ্ঠীর ভাষা লেখার বর্ণমালা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। ফলশ্রুতিতে এথনিক জনগোষ্ঠীরা দিন দিন ক্রমাগতভাবে বাংলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণে আকৃষ্ট হচ্ছে। এর ফলে সহাবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ফলে এখনিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের মূল রাজনৈতিক ধারার সাথে বিভিন্ন এথনিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা বর্তমানে স্বকীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে।

পরিশেষে বলা যায়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে ভাষাগত সমন্বয় সাধন হচ্ছে। এছাড়াও সাংস্কৃতিক ঐক্য সাধন, অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সৃষ্টি, ধর্মীয় সম্প্রীতি, শিক্ষার এই একত্রীকরণ, সামাজিক উন্নয়ন প্রভৃতি ঘটছে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এথনিক জনগোষ্ঠীর স্বকীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে।


সাঁওতালদের ধর্মবিশ্বাস ও বিবাহপ্রথা

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে অন্যতম হলো সাঁওতাল। সাঁওতাল উপজাতি উপমহাদেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠী। এরা এদেশের অধিবাসী নয়। সাঁওতালরা প্রথম কবে, কোথা থেকে এবং কীভাবে এ উপমহাদেশে এসেছিল, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নি। তারপরেও সাঁওতালরা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে এবং এখানে তারা পূর্ণাঙ্গভাবে জীবনযাপন শুরু করে।

সাঁওতালদের ধর্মবিশ্বাস: সাঁওতালদের শিক্ষিত সমাজে হিন্দুদের প্রধান প্রধান দেবদেবীর প্রাধান্য বর্তমান। বেগাভীল, গন্দি, কোল, কোরকা এবং সাঁওতাল প্রভৃতি উপজাতিদের আচার-ধর্ম ও ভাষ্যর সঙ্গে হিন্দুদের আচার-ধর্ম ও ভাষা এমনভাবে অতপ্রোতভাবে জড়িত যে, তাদের বৈশিষ্ট্য অনেকটা পৃথক এবং এজন্য এরা এখনও আদিবাসী তথা উপজাতি হিসেবে পরিগণিত। সাঁওতালদের দেবতার মধ্যে প্রধান হলো 'মারাং বুরো'। গ্রামের বা নিজেদের সকল প্রকার মঙ্গল-অমঙ্গল মারাং বুরোর ইচ্ছায়ই ঘটে থাকে বলে সাঁওতালরা বিশ্বাস করে থাকে। এ কারণে তার উদ্দেশ্যে সাদা মোরগ ও সাদা ছাগল উৎসর্গ করে তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়। তা ছাড়া কোনো উৎসব উপলক্ষ্যে প্রচুর মদও মারাং বুরোর নামে উৎসর্গ করা হয়।

সাঁওতালদের বিবাহপ্রথা: সাঁওতালদের সমাজে উপগোত্রের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। বর্তমানে তিন ধরনের বিবাহ রীতি প্রচলিত। যথা- আসলি বিবাহ, রাজারাজি ও হরকাটরা বিবাহ। আসলি বিবাহ ছেলে এবং মেয়ের অভিভাবকদের সম্মতিতে হয়। রাজারাজি বা মনোমিলন বিয়ের জন্য যুবক-যুবতীরা হাটে যায় এবং তারা উভয়ে উভয়কে পছন্দ করলে কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তির মাধ্যমে বিয়ের কার্য সম্পন্ন হয়। আর জ্বরকাটরা বিয়েতে যুবক-যুবতীতে জোর করে বিয়ে করে। এরূপ বিয়েতে যুবক তার পছন্দনীয় যুবতীকে যে-কোনো উপায়ে সিঁদুর পরিয়ে দেয়। সাঁওতালদের সামাজিক নিয়মে ফোনো যুবতীর কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিলে সে মেয়ের আর অন্যত্র বিয়ে হতে পারে না। এরপর নিয়মানুসারে গ্রাম্য পঞ্চায়েতের মাধ্যমে তাদের বিবাহ সম্পন্ন করা হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বিবাহ ও ধর্মের ক্ষেত্রে তারা ঐতিহ্যবাহী নিয়মকানুন অনুসরণ করে। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার প্রসারের ফলে এদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

No comments:

Post a Comment